অপরাধ
১.১ অপরাধ বলতে কি বুঝ? অপরাধের চারটি স্তর আলোচনা কর।
১.২ যে সকল কারণে একজন ব্যক্তি ফৌজদারি দায় হতে অব্যাহতি পায় তা আলোচনা কর।
১.১ অপরাধ বলতে কি বুঝ? অপরাধের চারটি স্তর আলোচনা কর।
অপরাধঃ
অপরাধের সংজ্ঞায় B. Bhushan (১৯৮৯) বলেছেন, অপরাধ বলতে বুঝায় গোষ্ঠীগত রীতিনীতির পরিপন্থী কোনো আচার-আচরণ। এসব আচরণ প্রতিষ্ঠিত কোনো গোষ্ঠী কিংবা তাদের আইন কর্তৃক অনুমোদিত নয়। এটি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য কষ্টদায়ক সমাজবিরোধী আচরণ।
সাধারণত অপরাধের দু’টি দিক রয়েছে।
সামাজিক— অর্থাৎ সমাজের বিধিবহির্ভূত কাজকে অপরাধ বলা হয় এবং
আইনগত— এটি রাষ্ট্রীয় আইনের পরিপন্থী আচরণ।
অর্থাৎ রাষ্ট্র বা আইন কর্তৃক অননুমোদিত কাজ হচ্ছে অপরাধ।
আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকেও অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। যেমন— সাদারল্যান্ড (E. H. Sutherland) তাঁর Principles of Criminology (১৯৫৫) গ্রন্থে বলেছেন, আইন লঙ্ঘনই অপরাধ। যেখানে কোনো আইন নেই সেখানে কোনো অপরাধও থাকে না। যখন কোনো আইন পাস করে বলবৎ করা হয়, পূর্বে যে কর্ম অপরাধমূলক ছিল না, এক্ষণে তা অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানী ফজলুর রশীদ খান (Fazlur Rashid Khan) অপরাধের সংজ্ঞায় আইনগত ও সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। তিনি তাঁর ‘Principles of Sociology’ গ্রন্থে বলেছেন, সাধারণভাবে বলতে গেলে একথা স্পষ্ট যে কোনো সমাজে লোকদের যেসব আচরণ নৈতিকতাবিরোধী ও সমাজবিরোধী সেগুলো অপরাধমূলক কর্ম বলে বর্ণনা করাই সর্বাপেক্ষা সহজতম পন্থা। আইন যেসব কর্মকে নিষিদ্ধ করে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণও সেসব কর্মকে সমাজের জন্য বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর বলে মনে করে। এটি স্বতঃসিদ্ধ।
বস্তুত অপরাধ হচ্ছে এমন আচরণ বা কৃতকর্ম যা সমাজে আপত্তিকর এবং আইন ও রাষ্ট্র কর্তৃক নিষিদ্ধ। অপরাধ সমাজে নিন্দনীয় এবং আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত। সমাজে এক ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয় লোকচক্ষুর অন্তরালে, অত্যন্ত প্রচ্ছন্নভাবে। এসব অপরাধ করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধী শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারে। এটি মূলত দুর্নীতি বা ভদ্রবেশী অপরাধ (White-collar crime। কর ফাঁকি দেওয়া, ঘুষ নেয়া, তহবিল তছরূপ করা ইত্যাদি এ শ্রেণির অপরাধ।
অপরাধের চারটি স্তর
সাধারণত অপরাধের চার (৪) টি স্তর আছে।
যথা- (১) পরিকল্পনা;
(২) প্রস্তুতি;
(৩) চেষ্টা;
(৪) সংঘটন।
(১) পরিকল্পনাঃ- অপরাধের প্রথম স্তরে অপরাধী বা অপরাধীরা পরিকল্পনা করে বা মনস্থির করে, কোথায় অপরাধ করবে, কার বিরুদ্ধে করবে, কিভাবে করবে, কারা কারা করবে ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে ইহা অপরাধী মন বা দুষ্টমন বা অপরাধী মন না থাকলে তাকে অপরাধী বলা যায় না। ইহা মনের ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য। A Person is liable when he intentionally commits a wrong.
অর্থাৎ অপরাধীকে তার অপরাধ সম্পন্ন করার অভিলাস বা উদ্দেশ্য থাকতে হবে।
(২) প্রস্তুতিঃ- পরিকল্পনা বা অপরাধী মনের ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য অপরাধীগন অপরাধ সংঘটনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ইহা অপরাধের দ্বিতীয় স্তর। সরাসরি করতে চাইলে লাঠি, ঢাল, বল্লম, ছুরি ইত্যাদি জোগাড় করেন। চুরি বা ডাকাতি করতে চাইলে চুরির বা ডাকাতির সরঞ্জাম জোগাড় করেন। কাউকে খুন করতে চাইলেও অপরাধীরা প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
(৩) চেষ্টাঃ- চেষ্টা অপরাধের তৃতীয় স্তর। মনের ইচ্ছা অনুসারে অপরাধী প্রস্তুতি নেয়; অতঃপর অপরাধের চেষ্টা করে, অনেক সময় সফল হয়, অনেক সময় সফল হয় না। সফল হলে অপরাধ সংঘটিত এবং সফল না হলে নির্দিষ্ট অপরাধ সংঘটিত হয় না। তবে অপরাধের চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়ায় তার জন্য তাকে শাস্তি ভোগ করতে হয়। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় যে, হারুন লিটনকে হত্যার উদ্দেশ্য ছুরি দ্বারা উপর্যুপরি আঘাত করে কিন্তু তার ডাক-চিৎকারে লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করে এবং চিকিৎসায় সে বেঁচে যায়। এইক্ষেত্রে হারুন লিটনকে হত্যার চেষ্টার অপরাধ করে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
(৪) অপরাধ সংঘটনঃ- অপরাধের চার (৪) টি স্তরের শেষ স্তরটি হলো অপরাধ সংঘটন। প্রথমে মনস্থিরকরণ অতঃপর প্রস্তুতি গ্রহণ অতঃপর চেষ্টা এবং চেষ্টা সফল হলেই অপরাধ সংঘটিত হয়। অর্থাৎ হারুন হত্যার উদ্দেশ্যে লিটনকে ছুরি দ্বারা উপর্যুপরি আঘাত করে এবং তার ফলে লিটন মারা যায় এবং তার ফলে হারুন খুনের অপরাধ করে।
ব্যতিক্রমঃ- এই চার (৪) টি স্তরের ব্যতিক্রমও আছে। যেমন- পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াও অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় যে, তর্কে পড়ে হারুন লিটনের নাকে ঘুষি মারে তখন লিটন হারুনকে ছুরি দ্বারা আঘাত করে। এখানে লিটনের পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। তবে দুষ্টমন পূর্বে না থাকলেও তাৎক্ষণিকাভাবে তার দুষ্টমন গড়ে ওঠে। এছাড়া অবহেলাজনিত কারণেও অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। যেমন- অবহেলাজনিত ভাবে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, অবহেলাজনিত ভাবে নির্মাণ কাজ করা ইত্যাদি।
যে সকল কারণে একজন ব্যক্তি ফৌজদারি দায় হতে অব্যাহতি পায় তা আলোচনা কর।
ফৌজদারী দায় হতে অব্যাহতি লাভের সাধারণ অজুহাত গুলি,/ ফৌজদারি দায় বহির্ভূত কার্যাবলী।
কোন ব্যক্তি কোন অন্যায় করলে তার দায় তাকে গ্রহণ করতে হবে এটাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু আমাদের দেশের প্রচলিত অপরাধ আইন বা দন্ডবিধিতে অনেক কাজকে ফৌজদারির দায় বহির্ভূত করা হয়েছে। যেমন: দন্ডবিধির ৭৬ হইতে ১০৬ ধারায় উল্লেখিত বিষয়গুলি।নিম্নে বিষয়গুলি আলোচনা করা হলো:
১) আইনত বাধ্য মনে করে কোন কাজ করলে: কোন ব্যক্তি যদি কোন কাজ করতে আইনত বাধ্য মনে করে এবং উক্ত কাজ করে তাহলে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। যেমন - পুলিশ অফিসার ভুল করে কোন নির্দোষ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করলে তা আইনত দর্শনীয় হবে না।
২) বিচারকের কাজ: বিচার বিষয়ক কার্য সম্পাদন করে বিচারক কর্তৃক সরল মনে কৃত কাজ অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে না।
৩) আদালতের রায় অনুসারে কাজ করলে: কোন আদালতে নির্দেশক্রমে কোনো কাজ করলে তা অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে না।
৪) আইন সমর্থিত মনে করে কোন কাজ করলে:আইন সমর্থিত বলে বিশ্বাস করে কোন কাজ করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না।
৫) দুর্ঘটনা: যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন ও যত্ন সহকারে কোন কাজ করার সময় কোন রূপ অপরাধজনক উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তাকে অপরাধ বলা যায় না।
৬) ক্ষতি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে কোন কাজ করলে:ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে এমন কাজের প্রতিরোধ মনে করে কোন কাজ করলে তা অপরাধ হবে না। ৭) শিশুর কোন কাজ: যাদের বয়স নয় বছরের কম তাদের কোন কাজই অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না।
৮) অপরিনত বোধশক্তি সম্পূর্ণ শিশুর কাজ: নয় বছরের বেশি কিন্তু ১২ বছরের কম এমন অপরিণত বোধশক্তি সম্পূর্ণ শিশুর কাজ অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে না।
৯) মানসিক অসুস্থ ব্যক্তির কাজ: মানসিক অসুস্থ বা অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তির কাজ অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে না।
১০) ভীতি প্রদর্শনে বাধ্য হয়ে কোন কাজ করলে: তাৎক্ষণিকভাবে মেরে ফেলতে পারে এমন আশঙ্কা থাকলে, ভিজি প্রদর্শনকারীর নির্দেশমত কোন অপরাধ জনক কাজ করতে বাধ্য হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। খুন এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ মূলক কাজ এরূপ ব্যতিক্রম কার্যকর হবে না।
১১) তুচ্ছ ক্ষতি: যে ক্ষতি এতই সামান্য যে সাধারণ বুদ্ধিমত্তার মানুষ তার জন্য সাধারণত কোন অভিযোগ করে না সেইরূপ কাজ অপরাধ নয়।
১২) আত্মরক্ষা: নিজের শরীর বা সম্পত্তি অন্যের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে না।
উপসংহার: দা একান্ত হুক আর পদার্থ হোক অর্থাৎ নিজের কাজের দ্বারা হোক বা অন্যের কাজের দ্বারা দায় হোক তা থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এড়িয়ে যেতে পারে না। কিন্তু যথাসাধ্য সতর্কতা অবলম্বন করে কোন কাজ করলে অন্যের ক্ষতি হলেও দায় গ্রহণ করতে হয় না।
0 Response to "অপরাধ"
Post a Comment