-->
আইন বিজ্ঞানের মতবাদ

আইন বিজ্ঞানের মতবাদ

১.১.  আইন বিজ্ঞানের মতবাদ বলতে কি বুঝ? 

১.১.২. আইন বিজ্ঞানে বিভিন্ন মতবাদের উদ্ভব হয়েছে বলে তুমি মনে কর? কেন আইন বিজ্ঞানের বিভিন্ন মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে?


১.২. আইন বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক ও সমাজতান্ত্রিক মতবাদের বৈশিষ্ট্য গুলো আলোচনা কর।  আইন বিজ্ঞানের ক) বিশ্লেষণধর্মী খ) ঐতিহাসিক গ) সমাজতান্ত্রিক মতবাদের বৈশিষ্ট্য গুলো আলোচনা কর।  

১.২.১. বিশ্লেষণাত্মক মতবাদ কিভাবে ঐতিহাসিক আইনবিজ্ঞান মতবাদ থেকে পৃথক? 

বিশ্লেষণাত্মক মতবাদ ও ঐতিহাসিক মতবাদের মধ্যে পার্থক্য-



১.১.  আইন বিজ্ঞানের মতবাদ বলতে কি বুঝ? 

আইন আলোচনা করেন বিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়। এই আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিভিন্ন আইন বিজ্ঞানী বিভিন্ন মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। কি বলেছেন এটি হল সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ আবার কেউ একে আধ্যাত্মিক সত্তা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। প্রত্যেকেই তাদের স্বশর মতবাদের যুক্তি দিয়েছেন। আইনের উৎস , আইনের উদ্দেশ্য,  আইনের প্রকৃতি,  ইত্যাদি জানতে হলে মতবাদগুলো বিশ্লেষণ করা জরুরী।

আইন বিজ্ঞানের মতবাদ ( School of Jurisprudence) : আইনের পর্যালোচনার করা আইন বিজ্ঞানের অন্যতম উদ্দেশ্য। আইনের স্বরূপ বা প্রকৃতি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। আইনের উৎস, আইনের ক্রমবিকাশ, আইনের উদ্দেশ্য, আইনের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সম্পর্কে বিভিন্ন আইন বিজ্ঞানী বিভিন্ন মতামত পোষণ করেছেন। আইনবিজ্ঞানীগণের এ সকল মতবাদ কে আইন বিজ্ঞানের মতবাদ বলা হয়।

আইনের সৃষ্টি ও ক্রম বিকাশের ক্ষেত্রে কোন কোন মতবাদে বলা হয়েছে যে, আইন সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রের জন্মেরও পূর্বে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন মতবাদের নাম উল্লেখ করা হলো-

১) ঐতিহাসিক মতবাদ

২) তুলনামূলক মতবাদ

৩) বিশ্লেষণাত্মক মতবাদ

৪) সমাজতান্ত্রিক মতবাদ

৫) নৈতিক মতবাদ

৬) দার্শনিক মতবাদ

৭) অর্থনৈতিক মতবাদ


১.১.২. আইন বিজ্ঞানে বিভিন্ন মতবাদের উদ্ভব হয়েছে বলে তুমি মনে কর? কেন আইন বিজ্ঞানের বিভিন্ন মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে?

কেন আইন বিজ্ঞানের বিভিন্ন মতবাদের উদ্ভব হয়েছে: 

আইনের পর্যালোচনা করাই আইন বিজ্ঞানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। যদিও আইনের সৃষ্টি ও ক্রম বিকাশ নিয়ে বিভিন্ন আইন বিজ্ঞানীগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। যার ফলে বিভিন্ন মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে অর্থাৎ আইনের সৃষ্টি, ক্রমবিকাশ, লক্ষ, উদ্দেশ্য, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সম্পর্কে আইন বিজ্ঞানীগণ যে সকল ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ পোষণ করেছেন তাকেই 'আইন-বিজ্ঞানের মতবাদ' বলা হয়।

আমি বিজ্ঞানের বিভিন্ন মতবাদ আইন বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রত্যেক মতবাদের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রত্যেক মতবাদের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। 

আইন বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আইনবিজ্ঞান অধ্যয়ন অতঃপর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। যার কারণে তাদের মতবাদ ভিন্ন ভিন্ন স্কুল বা মতবাদে বিভক্ত হয়েছে। স্থান-কাল পাত্র ভেদে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে। 

পরিশেষে বলা যায় যে, আইনের সৃষ্টি ও আইন ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে আইন বিজ্ঞানের বিভিন্ন মতবাদ সৃষ্টি হলেও আইন বিজ্ঞানে এই সকল মতবাদ সমূহের গুরুত্ব অপরিসীম।


১.২. আইন বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক ও সমাজতান্ত্রিক মতবাদের বৈশিষ্ট্য গুলো আলোচনা কর।  আইন বিজ্ঞানের ক) বিশ্লেষণধর্মী খ) ঐতিহাসিক গ) সমাজতান্ত্রিক মতবাদের বৈশিষ্ট্য গুলো আলোচনা কর।  

বিশ্লেষণাত্মক মতবাদের আলোচনা-

স্যার হেনেরি মেইন সর্বপ্রথম বিশ্লেষণাত্মক মতবাদের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। কিন্তু এই মতবাদের প্রধান প্রবক্তা হিসেবে ধরা হয় ব্রিটিশ আইন বিজ্ঞানী স্যার জন অস্টিনকে ( Sir John Austin)। ১৮৩২ সালে তিনি" The Province of Jurisprudence Determined" নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই মতবাদের বিশেষ ঈদের অভিমত হলো "সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশই হল আইন।" আইন অতীতে কিরূপ ছিল বা ভবিষ্যতে কিরূপ হতে পারে তার কোন গুরুত্ব এই মতবাদে নেই। নেয় অন্যায়ের প্রতি বিশ্লেষণার্তক মতবাদ উদাসীন। এই মতবাদের দুটি শ্রেণীর লোকের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়: এক শাসক শ্রেণী, যারা আদেশ করেন। দুই শাসিত শ্রেণী, যারা সেই আদেশ পালন করেন। বিশ্লেষণাত্মক মতবাদ অনুযায়ী সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ হলো আইন, সুতরাং তা পালন করা প্রত্যেকের জন্য বাধ্যতামূলক। নতুন মতবাদের সমর্থকের মধ্যে রয়েছেন - বেনথাম , হবস, হল্যান্ড, অস্টিন, ও এলেন প্রমুখ মনীষীগণ। 


ঐতিহাসিক মতবাদের আলোচনা- 

যে মতবাদ মনে করে আইন কেউ তৈরি করেনি, এটি ধীরে ধীরে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে সেই মতবাদকে ঐতিহাসিক মতবাদ বলে।ঐতিহাসিক মতবাদের অনুসারীদের মতে প্রতিটি আইন ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। ঐতিহাসিক মতবাদের প্রবক্তা হলেন স্যাভিগনি ( Savigny)। এই মতবাদে আইন কে কোন সার্বভৌম আদেশের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে বলে স্বীকার করা হয় না। ঐতিহাসিক মতবাদের অনুসারীগণ মনে করেন আইন চিরায়িত কোথা থেকে তৈরি হয়েছে। ঐতিহাসিক মতবাদের প্রবক্তা সেভিগনি ও স্যার হেনরি মেইন এই মতকে সমর্থন করেন এবং এর সমর্থনে সমাজের আইনের উপর গবেষণা কাজ পরিচালনা করেন। তাদের মতে, সার্বভৌম শক্তি বিকাশ লাভ করার পূর্বে মানুষ প্রথাকে মেনে চলতো। অর্থাৎ রাষ্ট্র ওজন্ম হওয়ার পূর্বে আইনের জন্ম হয়েছে নিম্নে সংক্ষেপে ঐতিহাসিক মতবাদ এর বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো-

১) এই মতবাদ আইনকে কোন সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ বলে স্বীকার করে না। ২) এই মতবাদ অনুযায়ী আইন ঐতিহাসিক বিবর্তনের একটি ফসল মাত্র।৩) এই মতের অনুসারীগণ আইনকে অতি অভিজ্ঞতার ফসল মনে করেন।৪) এই মতের অনুসারীগণ আইনের সাথে জনমত ও নৈতিকতার যুগ সূত্র রয়েছে বলে মনে করেন।৫) তোর অনুসারীগণ বিচার বিভাগীয় পূর্ব নজিরকে আইন বলে গণ্য করেন।৬) এই মতের অনুসারীগণ আইনকে প্রথা থেকে উদ্ভূত বলে মনে করেন।


সমাজতান্ত্রিক মতবাদের আলোচনা- 

ঐতিহাসিক মতবাদে আইনকে যেমন সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ বলে স্বীকার করা হয় না তেমনি সমাজতান্ত্রিক মতবাদেও আইনকে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের সৃষ্টি বলে মনে করা হয় না।

সমাজতান্ত্রিক মতবাদে আইনকে সমাজের সৃষ্টি হিসেবে গণ্য করা হয়। সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ বা সরকার তাকে বৈধতা দান করে । অর্থাৎ এই মতবাদের অনুসারীদের মতে সমাজের প্রয়োজনে আইন তৈরি হয় বা প্রণয়ন করা হয়। 

এই মতবাদের প্রবর্তক হলেন- ফ্রান্সের ডুগুইট (Duguit) এবং হল্যান্ডের ক্রাবে ( krabbe)। সমাজতান্ত্রিক মতবাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো- ১) এই মতবাদের অনুসারীগণ সমাজকে আইনের উৎস বলে মনে করেন।২) এই মতবাদের অনুসারীগণ মনে করেন, সামাজিক কল্যাণ সাধনের মধ্যেই প্রকৃত সার্থকতা নিহিত আছে। ৩) এই মতবাদের অনুসারীগণ শাস্তিদানের নীতি অপেক্ষা সামাজিক উদ্দেশ্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।৪) এই মতবাদের অনুসারীগণ মনে করেন, সমাজ জীবনে অনুপোযোগী আইন বেশি দিন টিকে থাকে না। 



১.২.১. বিশ্লেষণাত্মক মতবাদ কিভাবে ঐতিহাসিক আইনবিজ্ঞান মতবাদ থেকে পৃথক? 

বিশ্লেষণাত্মক মতবাদ ও ঐতিহাসিক মতবাদের মধ্যে পার্থক্য-

এমনি বিশ্লেষণ মতবাদ এবং ঐতিহাসিক মতবাদের মধ্যে পার্থক্য উল্লেখ করা হলো: 

১) যে মতবাদে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশকে আইনে হিসেবে ধরা হয় এবং সকলের জন্য তামান্ন করা বাধ্যতামূলক মনে করা হয় সেই মতবাদকে বিশ্লেষণাত্মক মতবাদ বলা হয়। 

অপরদিকে যে মতবাদ মনে করে আইন কেউ তৈরি করেনি, এটি ধীরে ধীরে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে সেই মতবাদকে ঐতিহাসিক মতবাদ বলা হয়।

২) বিশ্লেষণ মূলক মতবাদের প্রতিশব্দ Analytical School । 

অপর দিকে ঐতিহাসিক মতবাদের প্রতিশব্দ Historical school।

৩) বিশ্লেষণমূলক মতবাদের অনুসারীদের মতে আইন হলো সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ। পক্ষান্তরে ঐতিহাসিক মতবাদের অনুসারীদের মতে প্রতিটি আইন ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে।

৪) বিশ্লেষণ মূলক মতবাদ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ আইন সৃষ্টি করেছে।

 কিন্তু ঐতিহাসিক মতবাদ অনুযায়ী আইন আপনার কি সৃষ্টি হয়েছে।

৫) বিশ্লেষণমূলক মতবাদ অনুযায়ী মানুষ আইন মেনে চলে রাষ্ট্রের শাস্তির ভয়ে। অপরদিকে ঐতিহাসিক মতবাদ অনুযায়ী মানুষ আইন মেনে চলে সমাজের ভয়ে। 

৬) বিশ্লেষণমূলক মতবাদ দ্বারা আইনের বর্তমান প্রেক্ষাপট দেখা হয়। পক্ষান্তরে ঐতিহাসিক মতবাদ দ্বারা আইনের ঐতিহাসিক পটভূমি দেখা হয়। 

৭) বিশ্লেষণ মূলক মতবাদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের সৃষ্টি হবার পরই আইন সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে ঐতিহাসিক মতবাদ অনুযায়ী রাষ্ট্র সৃষ্টি হবার পূর্বে আইনের সৃষ্টি হয়েছে। 

৮) বিশ্লেষণাত্নক মতবাদের প্রবক্তা হলেন স্যার জন অস্টিন ( Sir John Austin )। অন্যদিকে ঐতিহাসিক মতবাদের প্রবক্তা হলেন স্যাভিগনি ( Savigny)। 

উপসংহার: বিভিন্ন আইনবিজ্ঞানী আইন-বিজ্ঞানের বিভিন্ন মতবাদ উল্লেখ করেছেন। তবে তাদের মতবাদের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। এই মতবাদ গুলির যেকোনো একটি মতবাদ দেওয়া হলে আইনের এক একটা দিক অসম্পূর্ণ হয়ে যায়। সুতরাং বলা যায়- আইনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশে এই মতবাদ গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

0 Response to "আইন বিজ্ঞানের মতবাদ"

Post a Comment

Ads