‘ঘুষ’ না দেওয়ায় ১১ বছরের বেতন বকেয়া ৩৫ শিক্ষক-কর্মচারীর
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের উপ-পরিচালক (কলেজ-২) মো. এনামুল হক হাওলাদার কলেজটির ৩৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীদের বকেয়া টাকা ছাড়তে প্রায় চার কোটি টাকা ঘুষ চান। টাকা না পেয়ে দফায় দফায় বেতন ভাতা পরিশোধে বিরোধিতাও করেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহীর দুর্গাপুরের আলীপুর মডেল কলেজটি প্রথম এমপিওভুক্তির আদেশ পায় ২০০৪ সালের ৫ জুন। শিক্ষক-কর্মচারীর নামবিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ফাঁকা এমপিও শিট পাঠানো হয় কলেজে। ২০০৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০০৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষক-কর্মচারীর নামবিহীন এমপিও শিট চলমান রাখার ব্যবস্থা নেন উপ-পরিচালক।
অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করায় ২০০৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানের এমপিও স্থগিত করা হয়। ২০০৮ সালের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করায় এমপিও ছাড় করা হয় ওই বছরের ১২ নভেম্বর। কিন্তু কলেজটির অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি না থাকায় এমপিও দেওয়া হয়নি। এরপর ২০১১ সালের ২০ মার্চ অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতির কাগজপত্র জমা দেন অধ্যক্ষ। তারপরও শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও ছাড় করা হয়নি।
আদালত অবমাননা
এই পরিস্থিতিতে ২০১১ সালে কলেজের পক্ষে হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন দায়ের করেন ওই সময়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ (বর্তমানে অধ্যক্ষ) মো. সাইফুল ইসলাম। ২০১৭ সালের ৩১ মে রিট পিটিশনের রায়ে ২০০৮ সালের ১২ নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মোট ১১ বছর ৭ মাস ১৯ দিনের বকেয়া প্রদানের নির্দেশ দেন আদালত। রায় বাস্তবায়ন না হলে ২০১৮ সালে উচ্চ আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করেন অধ্যক্ষ। ২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল আদালত অবমাননার রায়ে বাদী-বিবাদীর সশরীরে উপস্থিতিতে শুনানির সময় নির্ধারণ করতে বলা হয়। এছাড়া রায়ে ২০১৭ সালের ৩১ মে’র আদেশ প্রতিপালন করতে অব্যর্থভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়।
আদালত অবমাননার রায়ের পর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর তড়িঘড়ি করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর আপিল আপিল আবেদন খারিজ করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্ট।
দ্বিতীয় দফা এমপিওভুক্তিতেও বেতন মেলেনি
উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর পরের বছর ২০১৯ সালের ১৮ মে এমপিও বৈঠকে এমপিওভুক্তির সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্তের পর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের নামবিহীন এমপিও শিট পাঠায় কলেজে। ফলে বেতন বঞ্চিত হন ৩৫ জন শিক্ষক-কর্মচারী।
আদালতের নির্দেশেও বেতন না পেয়ে কলেজের পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানান অধ্যক্ষ। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি আদালতের রায় বাস্তবায়নে দ্বিতীয় দফা নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। তারপরও এমপিও বঞ্চিত হন শিক্ষক-কর্মচারীরা।
দালালের মাধ্যমে ঘুষের প্রস্তাব
এই পরিস্থিতিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের উপ-পরিচালক (কলেজ-২) মো. এনামুল হক হাওলাদারের পক্ষে সাংবাদিক পরিচয়ধারী চাঁপাইনবাবগঞ্জের শফিউর রহমান নামের একজন দালাল অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দালাল শফিউর রহমান অধ্যক্ষকে বলেন, ‘এমপিওভুক্ত হতে হলে উপ-পরিচালকের (কলেজ-২) সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তাহলে এমপিও পাবেন, না হলে পাবেন না।’
শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে অধ্যক্ষ দালালের মাধ্যমে উপ-পরিচালক (কলেজ-২) মো. এনামুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। উপ-পরিচালক দালাল শফিউরের সঙ্গে কথা চূড়ান্ত করতে বলেন। তাছাড়া এমপিও পাবেন না বলেও জানিয়ে দেন। বাধ্য হয়ে সুদের ওপর টাকা নিয়ে মো. এনামুল হাওলাদারকে ৫০ লাখ টাকা দেন অধ্যক্ষ মো. সাইফুল ইসলাম।
অধ্যক্ষের বক্তব্য
আলীপুর মডেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. সাইফুল ইসলাম শিক্ষা ডটকমকে বলেন, ‘শিক্ষক-কর্মচারীরা মিলে দফায় দফায় ৫০ লাখ টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি। আর কলেজের নাম এমপিও সার্ভারে উঠাতে দেওয়া হয়েছে আরও ২৬ লাখ। টাকা নেওয়ার পর ২০১৯ সালের ১৮ জুন ইএমআইএস সেলের সিস্টেম এনালিস্টকে পত্র দেন এনামুল হাওলাদার। মোট ৭৬ লাখ টাকা দেওয়ার পর ২০১৯ সালের ১৮ মে’র বৈঠকে এমপিওভুক্তির সিদ্ধান্ত হয়। ওই সিদ্ধান্তের আলোকে ২০২০ সালের ১৫ জুন রাজশাহীর আঞ্চলিক পরিচালককে এমপিওভুক্তির নির্দেশনা দিয়ে পত্র পাঠায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর। কিন্তু বিদ্যমান ৩৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা চালু হয় ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে। আদালতের রায় অমান্য করে বকেয়া সৃষ্টি করা হয় ২০০৮ সালের ১২ নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মোট ১১ বছর ৭ মাস ১৯ দিনের।
কলেজের অধ্যক্ষ শিক্ষা ডটকমকে আরও বলেন, ‘এনামুল হাওলাদারের সঙ্গে চুক্তি ছিল—আদালতের রায় অনুযায়ী ২০০৮ সালের ১২ নভেম্বর থেকে ৩৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীর এমপিও ছাড় হবে, কিন্তু তা দেওয়া হয়নি।’
অধ্যক্ষের আত্মহত্যার চেষ্টা
কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ের প্রভাষক শামিনুল ইসলাম খন্দকার বলেন, সুদের ওপর ৭৬ লাখ টাকা নিয়ে শিক্ষকরা মিলে বাধ্য হয়ে ঘুষ দিয়েছি উপ-পরিচালক এনামুল হাওলাদারকে। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। সুদের ঝামেলা সহ্য করতে না পেরে অধ্যক্ষ গত ২ জুন আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। পরে তাকে রাজশাহী মেডিক্যালে নিয়ে সুস্থ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘অধ্যক্ষের আত্মহত্যার চেষ্টার পর থেকে যে দালালের মাধ্যমে উপ-পরিচালক টাকা নিয়েছেন তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। প্রয়োজনে তাকে খুঁজে বের করা হবে।’
অধ্যক্ষ মো. সাইফুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে সপরিবারে মরে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না।’
সর্বশেষ অবস্থা
এসব ঘটনার পর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বকেয়া বেতন চেয়ে আবেদন জানান অধ্যক্ষ। আদালতের রায় অনুযায়ী ব্যারিস্টারের অভিমতের পর আইন শাখা ২০০৮ সালের ১২ নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মোট ১১ বছর ৭ মাস ১৯ দিনের বকেয়া প্রদানের মত দেয়। সর্বশেষ গত ২৮ জুলাইয়ের এমপিও বৈঠকে শিক্ষক-কর্মচারীদের তথ্য বাচাই-বাছাই করে মোট ১১ বছর ৭ মাস ১৯ দিনের বকেয়া প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়।
উপ-পরিচালকের বক্তব্য
জানতে চাইলে উপ-পরিচালক (কলেজ-২) মো. এনামুল হক হাওলাদার শিক্ষা ডটকমকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে দয়া করে আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। পরিচালক স্যারের সঙ্গে আলাপ করতে পারেন। আমি তো স্পোকসম্যান না।’
এমপিও বৈঠকের আগে কলেজের অধ্যক্ষকে টাকার জন্য ফোন দিয়েছিলেন কিনা জানতে চাইলে কোনও জবাব দেননি উপ-পরিচালক। আগেও এসব শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে ভয় দেখিয়ে ৭৬ লাখ টাকা নিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি প্রথমে চুপ থাকেন। পরে বলেন, ‘এটা সত্য নয়।’ দালাল শফিউরের মাধ্যমে টাকা চাওয়ার বিষয়ে এনামুল হক হাওলাদার বলে, ‘আমি তাকে চিনি না।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বকেয়ার অর্ধেক দেওয়ার সিস্টেম তৈরি করেছেন উপ-পরিচালক নিজেই। স্বার্থসংশ্লিষ্ট ফাইল হলেই আমাকে ডেকে সই করিয়ে নেন। ঠিকমতো পড়তেও দেন না। আমার কিছু করার নেই।’
শিক্ষা ডটকমের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
------------------------------
প্রাইমারি, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা, বৃত্তি, উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সংবাদ শিরোনাম, প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, ছবি, ভিডিও পেতে শিক্ষা ডটকমের ফেইসবুক গ্রুপে ফলো করুন ( ফলো করতে ক্লিক করুন এখানে )।
------------------------------
শিক্ষা ডটকমের ফেইসবুক পেইজঃ শিক্ষা - Shikkhaa.com | Facebook
0 Response to "‘ঘুষ’ না দেওয়ায় ১১ বছরের বেতন বকেয়া ৩৫ শিক্ষক-কর্মচারীর"
Post a Comment