শিক্ষিকাকে কান ধরে ওঠবস, কোথায় চলেছি আমরা?
ছোটবেলায় শিক্ষকদের দেখেছি, ছাত্রদের কান ধরে উঠবস করাতে। কিন্তু পরিস্থিতি একটু বদলে গেছে। শিক্ষকদেরও কান ধরে উঠবস করানো হচ্ছে। সেই কাজটিও করছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নিজে। যে ঘটনার কথা বলছি, তা ঘটেছে রাজশাহীতে। পবা উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষককে ফেসবুকে ছবি দেওয়ার অপরাধে কান ধরে ওঠবস করানোর শাস্তি দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক। সহকারী শিক্ষিকার ফোনটিও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এমন ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষিকা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে বেশ সরল মনে হলেও আদৌ তা নয়। সম্প্রতি কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে সংশয় প্রকাশের সুযোগ আছে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে কিছু বিশ্বাস করার সুযোগ নেই। এই যেমন কদিন আগেই এক শিক্ষিকার অসম বিয়ের ঘটনা নিয়ে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল তা যেন আমাদের বারবার অনিশ্চয়তার দিকেই ঠেলে দেয়। জনমত এখন সংশয়ে ভরা। ফলে এমন ঘটনা দেখে আমরা তেমন চিন্তিত হই না। যা বলছিলাম, ভুক্তভোগী শিক্ষকের অপরাধ ফেসবুকে একটি ছবি দেওয়া। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার দাবি, ওই সহকারী শিক্ষিকা তার ছবি বিকৃত করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়েছেন। এমন অপরাধ ডিজিটাল আইনের আওতায় পড়ে। তবে ভুক্তভোগী শিক্ষিকার স্বামী নেই এবং অসহায় বলে মানবিক বিবেচনায় লঘু শাস্তি দিয়েছেন। যদিও অভিযুক্ত শিক্ষিকার দাবি, এমন কিছু তিনি করেননি এবং যে ছবি ফেসবুকে দিয়েছেন, তা প্রধান শিক্ষিকাই তাকে দিয়েছিলেন।
এখানে কিছু বিষয় লক্ষণীয়। প্রধান শিক্ষিকা এই শিক্ষিকার অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করেই এমন শাস্তি দিয়েছেন। কিন্তু এমন শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আদৌ কি তার আছে? যদি তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় পড়ে, তাহলে আইনিভাবেই তা সমাধানের চেষ্টা কেন করা হলো না? আমরা আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের কথা বলি। কিন্তু সেই আইনের সাহায্য নিতে গিয়ে কেন এত কুণ্ঠা? সে জন্যে কি শাস্তির বিধান প্রধান শিক্ষিকাকেই নিতে হলো? অর্থাৎ অপরাধের শাস্তি যে কেউ দিতে পারে?
অবশ্য প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের অভিভাবক। একজন প্রধান শিক্ষক ছাত্রদের জন্যে যেমন অভিভাবক, তেমনই সহকারীর শিক্ষকদেরও অভিভাবক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে একটি সামান্য পদ হিসেবে ভাবার অবকাশ নেই। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানের সমান। সেখানে অবিবেচকের মতো শাস্তি বিধানের বিষয়টি আমাদের কি এই ইঙ্গিত দেয় না যে, দেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় যারা আছেন তারা অযোগ্য?
সহকারী শিক্ষিকার এই শাস্তি দেওয়ার সময় অবশ্য প্রধান শিক্ষিকার স্বামী ও বিদ্যালয়ের জমিদাতা উপস্থিত ছিলেন। ধরে নেওয়া যায়, তাদের সম্মতিতেই ও সম্ভবত সম্মতি আদায়ক্রমেই এমন শাস্তি দেওয়া হয়েছে। একজন শিক্ষক জনসম্মুখে কান ধরে ওঠবস করছেন। কান ধরে ওঠবস করার বিষয়টি কিভাবে এসেছে? গ্রামে চুরি কিংবা জঘন্য অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের জনসম্মুখে কান ধরে ওঠবস করানো হয়। সামাজিকভাবে কান ধরে ওঠবস করা কিংবা কানকে টেনে ধরার সঙ্গে জঘন্য অপকর্মের শাস্তির বিষয়টি জড়িত। সে জন্যেই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের এমন শাস্তি দেওয়া হয়, যেন তারা লজ্জা পান। সেটাও একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত। কারণ এমন স্পর্শকাতর বিষয় অনেক সময়ই শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সেখানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীকে জনসম্মুখে কান ধরে ওঠবস করানোর বিষয়টি কেমন হতে পারে? ওই শিক্ষকের সামাজিক অবস্থান থেকে এমন সিদ্ধান্তে কেমন প্রভাব ফেলবে, তা কি নারী হয়েও প্রধান শিক্ষক ভেবে দেখেছেন?
একের পর এক প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে উঠছে মন। অবশ্য প্রশ্ন করার অভ্যাস বহু আগেই উঠে গেছে আমাদের সমাজে। তবে এই ঘটনা যেন নারীর প্রতি অবমাননার চিত্র আরও প্রকট করে তুলছে। একজন নারীর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাকে অপদস্থ করা আর যাই হোক শাস্তি হতে পারে না। এমনকি এমন শাস্তির বিধান করার আইনি যুক্তি কী, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সে বিষয়ে আগেও কথা বলেছি।
সারাদেশেই শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত অনেক মানুষকেই নানাভাবে অবহেলা, অপমান ও অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। এর আগেও আমরা দেখেছি একজন শিক্ষককে গলায় জুতোর মালা পরিয়েছে জনগণ। আইনের প্রহরায় তাকে নিরাপত্তা দিয়েছে অপমান ভোগ করিয়ে। শিক্ষককে খুন করছে ছাত্র। সেও হিরোইজম প্রদর্শনের জন্যে। এদিকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা কান ধরে ওঠবস করাচ্ছেন ফেসবুকে ছবি দেওয়ার অপরাধে। কেড়ে নিচ্ছেন ব্যক্তিগত ফোন। এই ফোন জব্দ করার বিষয়টিও কেমন অদ্ভুত।
প্রাইভেসি নিয়ে আমাদের আবার আরেক ধোঁয়াশা আছে। ফেসবুকে ছবি দেওয়া ও তাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন। ভুক্তভোগী শিক্ষিকার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে। তা যদি আদৌ সত্য হয় তাহলে তিনিও কিছুটা অপরাধী তো বটেই। প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার না করার দায় তার ওপর বর্তায়। তবে আপাতত সেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। যা দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে ক্ষমতার অপব্যবহার। কর্মক্ষেত্রে তা যেন বারবার উঠে আসছে। শুরু হচ্ছে নানাবিধ ধোঁয়াশা। অসহায় বলে তাকে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সামাজিকভাবে হেনস্তা কিভাবে লঘুদণ্ড হতে পারে?
পরবর্তী সময়ে এই নারী শিক্ষক যখন বিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে যাবেন তখন ছাত্রদের সামনে তার অবস্থান কেমন থাকবে? তিনি নিজে থেকেই সংকোচবোধ করবেন। আবার ছাত্র-ছাত্রীরাও প্রকাশ্য কিংবা আড়ালে তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করবেন। অনেকে তো তাকে সম্মানই করবে না। সামাজিকভাবেও নানা মানুষের কথা তাকে কোণঠাসা করে দেবে। বিশেষত নারীদের সমাজে নানা রকম বাজে মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয়। এমন একটি ঘটনা তার জন্যে যদি ভুক্তভোগী শিক্ষিকা অপরাধী হয়েও থাকেন, তাহলেও প্রধান শিক্ষিকার অপরাধকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সামাজিকভাবে একজন মানুষকে অপদস্থ করার অপরাধে তিনি অপরাধী।
যেমনটা আগেও বলেছি, ঘটনার বিস্তারিত এখনো আমরা জানি না। তাই নিশ্চিত হয়ে কিছু বলার সুযোগ নেই। কিন্তু এই সংশয়ের মাঝেও ভয়ঙ্কর সব আশঙ্কা মনে জমা হয়। প্রাথমিক স্তরে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন শিক্ষকরা প্রধান শিক্ষকের ভূমিকায়? সমস্যা নিরসনে এমন সিদ্ধান্ত তাদের অযোগ্যতার পরিচয় দেয়। যেখানে শিক্ষকের মধ্যেই অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিবেচনাবোধ নেই, সেখানে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে? আরেকটি বিষয় যেন কিছুটা আমাদের নজরে আসে। কর্মক্ষেত্রে নারীকে সবসময় ক্ষমতার চাপে পিষ্ট হতে হয়। মানবিক বিবেচনা ও অসহায়ত্বের অজুহাতে তাকে সামাজিক হেনস্তা করা যেতে পারে। তবে আইনের আওতায় আনলে তার ক্ষতি হয়ে যাবে। অর্থাৎ ব্যক্তির সম্মান, আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা যায়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা কেমন পদক্ষেপ নেবেন, তা এখন দেখার বিষয়। শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত অনেকেই নানাভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। একথাও মনে রাখতে হবে, শিক্ষকতার সঙ্গে নারীদের একটি বিরাট অংশ জড়িত। সেই তারাই নানাভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কিছু কিছু নারী আবার অবহেলিত নারীদের হেনস্তা করছেন। বিশেষত একটি দায়িত্বশীল পদে গিয়েও ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিতিশীলতা কোনোমতেই কাম্য নয়। এ বিষয়ে অতি দ্রুত জনমত গঠন ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। নতুবা প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা দ্রুতই ভেঙে পড়বে। যখন কারিগরই আত্মমর্যাদাহীন হবে, ভবিষ্যতের নাগরিক হিসেবে শিক্ষার্থীরাই বা প্রস্তুত হবে কিভাবে? এও এক ধোঁয়াশাময় প্রশ্ন।
লেখক : আফরিদা ইফরাত, সংবাদকর্মী।
শিক্ষা ডটকমের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
------------------------------
প্রাইমারি, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা, বৃত্তি, উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সংবাদ শিরোনাম, প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, ছবি, ভিডিও পেতে শিক্ষা ডটকমের ফেইসবুক গ্রুপে ফলো করুন ( ফলো করতে ক্লিক করুন এখানে )।
------------------------------
শিক্ষা ডটকমের ফেইসবুক পেইজঃ শিক্ষা - Shikkhaa.com | Facebook
0 Response to "শিক্ষিকাকে কান ধরে ওঠবস, কোথায় চলেছি আমরা?"
Post a Comment