
ক্লাসের অস্বাভাবিক চাপে প্রাথমিক শিক্ষকরা
নোয়াখালী সদরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিন জন শিক্ষক রয়েছেন। ফলে তিন জন শিক্ষককেই বিরতিহীন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য ক্লাসে থাকতে হয়। বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ নেই। দেশে এমন কয়েক হাজার স্কুল রয়েছে বলে জানিয়েছে প্রাথমিকের শিক্ষক সংগঠনগুলো। দেশে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩ লাখ ৫৬ হাজার শিক্ষক রয়েছেন। এর বাইরেও সরকারি ও বিভিন্ন সংস্থা প্রাথমিক স্কুল পরিচালনা করছে। সব মিলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ লাখ ২৯ হাজার। আর সবমিলে শিক্ষক ৭ লাখ ২২ হাজার। অধিকাংশ স্কুলেই শিক্ষকসংকট চলছে। তবে বর্তমানে ৩৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা চলছে। সেপ্টেম্বরের পর এসব শিক্ষক যোগদান করবেন বলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
আরো পড়ুনঃ নিকটবর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয় একীভূত করা হবে: গণশিক্ষা সচিব
শিক্ষকরা বলেছেন, মহানগরীতে প্রাথমিকের ক্লাস সকাল সোয়া ৭টা থেকে ৩টা পর্যন্ত। আর গ্রামাঞ্চলের স্কুল সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ৪টা পর্যন্ত। দুই শিফটের ক্লাসে সকালের শিফটে প্রাক প্রাথমিক, প্রথম ও দ্বিতীয় এবং দ্বিতীয় শিফটে তৃতীয়, চতুর্থ এবং ৫ম শ্রেণির ক্লাস হয়ে থাকে। প্রথম শিফটে ক্লাস হয় ৩/৪টি এবং দ্বিতীয় শিফটে ক্লাস হয় ছয়টি। যেখানে শিক্ষক সংকট সেখানে একজন শিক্ষককেই বিরতিহীন ৯/১০টি ক্লাস নিতে হয়। আর শিক্ষকসংকট না থাকলেও অন্তত একজন শিক্ষককে সাতটি ক্লাস নিতে হয়। যা সপ্তাহে গিয়ে দাঁড়ায় ৪২টিতে।
সিরাজগঞ্জ জেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৭৯টি শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে ৯৯টি প্রধান শিক্ষক এবং ৮০টি সহকারী শিক্ষকের পদ রয়েছে। এ অবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে জানা গেছে। শিক্ষকরা বলেছেন, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের পদগুলো শূন্য থাকার কারণে বর্তমানে দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষকরা বিপাকে পড়েছেন। তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। বেশি সংখ্যক ক্লাস নেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।
শিক্ষকরা বলেছেন, যে স্কুলে পাঁচ-সাত জন শিক্ষক, সেখানে এই সমস্যা বেশি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬০ ভাগের বেশি মহিলা শিক্ষক। মাতৃত্বকালীন ছুটি, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কারণে শিক্ষকদের সংখ্যা প্রায়ই কম থাকে। ডিপিইএড প্রশিক্ষণ প্রদানের ফলে শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ প্রশিক্ষণ গ্রহণে ব্যস্ত থাকেন। এছাড়া অবসরে যাওয়াসহ নানা কারণে ছুটিতে থাকায়ও শিক্ষকদের ওপর চাপ পড়ছে। এছাড়া অবসরে গেলেও শিক্ষক নিয়োগের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে সংকট নিয়েই চলতে হয় স্কুলগুলোকে।
প্রাথমিক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ মাছুম বিল্লাহ মনে করেন, প্রাথমিকের শিক্ষকদের ওপর এই বাড়তি চাপ কমানোর জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, প্রাথমিকের শিক্ষা প্রশাসন আমলারা নিয়ন্ত্রণ করেন। এই প্রশাসনে কোনো শিক্ষক নেই। এ কারণে শিক্ষকদের এই সমস্যা সমাধানে কার্যত কোনো উদ্যোগ নেই। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিকের জন্য পৃথক শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিস চালুর দাবি জানান এই শিক্ষাবিদ।
তিনি বলেন, সরকার কিন্ডারগার্টেন তুলে দিতে চায়। কিন্তু দেশের সরকারি প্রাথমিকের যে অবস্থা, এর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার বিদ্যমান সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির সভাপতি বদরুল আলম জানান, শিক্ষকদের বিরতিহীন ক্লাস-এটা খুবই অমানবিক। অত্যন্ত কষ্টের। সমস্যা সমাধান করার দাবি তার।
আর প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি শামসুদ্দিন মাসুদ বলেন, ক্লাসের চাপে শিক্ষকরা দিশেহারা। তারা মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। তাই ক্লাসের চাপ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী একটি জেলার এক শিক্ষা অফিসার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, শিক্ষকদের অমানবিক কষ্ট আমরা দেখছি। কিন্তু কিছুই করার নেই। প্রতিটি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের পদ আরো বাড়ানো উচিত। যাতে কোনো শিক্ষক ছুটিতে থাকলে অন্যদের ওপর তেমন চাপ না পড়ে। এছাড়া শিক্ষকদের বাইরের অন্য কাজে কোনোভাবে যুক্ত করা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে তা চাপিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি।
বাড়তি কাজ : শিক্ষকরা জানিয়েছেন, শিক্ষকদের পাঠদান ছাড়াও নানা ধরনের কাজ করতে হয়। ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও হালনাগাদ করা, শিশু জরিপ, আদমশুমারি, কৃষিশুমারি, কৃমির ট্যাবলেট, ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়ানোসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং পরিসংখ্যান বিভাগের সব কাজই করতে হয়। এছাড়া উপবৃত্তি তালিকা প্রণয়ন ও প্রাপ্তিতে সহযোগিতা, বিস্কুট খাওয়ানো ও হিসাব সংরক্ষণের কাজও করতে হয়।
শিক্ষকরা বলেন, প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকের বাইরে শুধু একজন নাইট গার্ড রয়েছেন। আয়া বা কোনো করণিক নেই। এ কারণে স্কুলের সব কাজই শিক্ষকদের করতে হয়। প্রত্যেক মাসে ছাত্র হাজিরা খাতায় নাম ওঠানো, দৈনন্দিন উপস্থিতি-অনুপস্থিতি হিসাব সংরক্ষণ, হোম ভিজিট, উপকরণ তৈরি, দৈনিক পাঠ পরিকল্পনা তৈরি, বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি তথ্যসহ নানা কাজ করতে হয়। ফলে স্কুল ছুটি হলেও শিক্ষকদের ছুটি মেলে না। এ কাজ করেই বাসায় ফিরতে হয়।
শিক্ষা ডটকমের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
------------------------------
প্রাইমারি, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা, বৃত্তি, উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সংবাদ শিরোনাম, প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, ছবি, ভিডিও পেতে শিক্ষা ডটকমের ফেইসবুক গ্রুপে ফলো করুন ( ফলো করতে ক্লিক করুন এখানে )।
------------------------------
শিক্ষা ডটকমের ফেইসবুক পেইজঃ শিক্ষা - Shikkhaa.com | Facebook
0 Response to "ক্লাসের অস্বাভাবিক চাপে প্রাথমিক শিক্ষকরা"
Post a Comment